হ‌ুমায়ূন আহমেদ: তাঁর যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তা-ই যথেষ্ট

by N_admin_1 | আগস্ট ৫, ২০২৫ ৭:৩৯ অপরাহ্ণ

Spread the love

‘ভিনি ভিডি ভিসি’ বলে একটা কথা আগে খুব শোনা যেত। এর মানে হলো: এলাম, দেখলাম, জয় করলাম- হ‌ুমায়ূন আহমেদের বেলায় এ কথা খাটানো যায়। তাঁর ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। সেই উপন্যাসের ভূমিকা লিখেছিলেন আহমদ শরীফ। তিনি হ‌ুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘‘জীবনের প্রাত্যহিকতার ও তুচ্ছতার মধ্যেই যে ভিন্নমুখী প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির জটাজটিল জীবনকাব্য তার মাধুর্য, তার ঐশ্বর্য, তার মহিমা, তার গ্লানি, তার দুর্বলতা, তার বঞ্চনা ও বিড়ম্বনা, তার শূন্যতার যন্ত্রণা ও আনন্দিত স্বপ্ন নিয়ে কলেবরে ও বৈচিত্র্যে স্ফীত হতে থাকে, এত অল্প বয়সেও লেখক তাঁর চিন্তা-চেতনায় তা ধারণ করতে পেরেছেন দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত।’’

‘নন্দিত নরকে’র অনবদ্য প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। আর আহমদ ছফার বদৌলতে সেই উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাবাজারের খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি থেকে। এর পরের গল্প কমবেশি অনেকেরই জানা। কীভাবে টিভি-নাটকে বিপুল জনপ্রিয়তা হ‌ুমায়ূন আহমেদকে কিংবদন্তিতে পরিণত করে দিয়েছিল। আহমদ শরীফ ‘নন্দিত নরকে’র সেই ছোট্ট ভূমিকাটির শেষ করেছিলেন এই লিখে, ‘‘হ‌ুমায়ূন আহমেদ বয়সে তরুণ, মনে প্রাচীন দ্রষ্টা, মেজাজে জীবন রসিক, স্বভাবে রূপদর্শী, যোগ্যতায় দক্ষ রূপকার। ভবিষ্যতে তিনি বিশিষ্ট জীবনশিল্পী হবেন- এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করব।’’

মাসিক ‘মুখপত্রে’র প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় গল্প হিসেবে ‘নন্দিত নরকে’ ছাপা হয়েছিল। পড়ে তাঁর লেখার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন আহমদ শরীফ। সময়টা ১৯৭২ সাল। বইয়ের সেই ভূমিকায় শরীফ তারিখটাও দিয়েছিলেন ১৬/৬/৭২। পরের বই ‘শঙ্খনীল কারাগারে’র ভূমিকা হ‌ুমায়ূন আহমেদ নিজেই লিখেছিলেন। তাতে জানা গেল: সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পরপরই নিম্নমধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার সুতীব্র ইচ্ছা হুমায়ূনের মনে জেগেছিল। ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ও ‘মনসুবিজন’ নামে তিনটি আলাদা গল্প সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলেছিলেন। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাসের অভাবে লেখা তিনটি দীর্ঘদিন পড়েছিল। পরে আহমদ ছফা ও বন্ধু রফিক কায়সারের আগ্রহে ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হয়। ছ’মাস পর প্রকাশিত হয় ‘শঙ্খনীল কারাগার’। ভূমিকার শেষে সময় দেওয়া আছে বৈশাখ ১৩৮০। মানে ১৯৭৩ সাল।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ ‘জীবনশিল্পী’ হওয়ার দিকে যাচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি হয়ে উঠলেন জনপ্রিয় লেখক। ‘লিখে জনপ্রিয় হওয়া, বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া- কোনোটাই কোনো দিক থেকেই দোষের নয়; না শিল্পের দিক থেকে, না নৈতিকতার দিক থেকে’ – সমরেশ বসুর মৃত্যুর পর শ্রদ্ধাঞ্জলিতে এমনটাই লিখেছিলেন দেবেশ রায়। সমরেশ বসুও প্রকাশকের চাপে ও চাহিদায় বিপুল পরিমাণে লিখেছেন। কিন্তু লেখকের দায়বদ্ধতা ও প্রকাশকদের মোকাবেলা পাল্টা ব্যবস্থা নিত্যই চালু রেখেছিলেন সমরেশ বসু। এই দায় মানে সাহিত্যের প্রতি দায়। মতবাদ ফলানো বা প্রতিবাদের দায় নয়। জীবনের শেষাবিধ, ‘দাহ’ উপন্যাস বা ‘দেখি নাই ফিরে’তে গিয়েও সমরেশ দায়বদ্ধ লেখকের জায়গা থেকে সরে আসেননি। বলিষ্ঠ জীবনবোধে তাপিত-তাড়িত-চালিত হয়েছিলেন সারাজীবন।

 

হ‌ুমায়ূনের সামর্থ্যও কম ছিল না। বিচিত্র ও বিপুলসংখ্যায় লিখেছেন তিনি। নিপাট সাহিত্য-প্রবন্ধ ছাড়া এমন কোনো বিষয় নেই যে লেখেননি। (মিসির আলিতে রহস্য আছে) সেই অর্থে গোয়েন্দা উপন্যাস কি লিখেছিলেন? লিখে থাকলেও সেসব উল্লেখযোগ্য নয়। লেখেননি ইরোটিক উপন্যাসও। (এখানে মারিও ভার্গাস ইয়োসাকে মনে পড়ছে। হেন বর্গ নেই যে মারিও লেখেননি, ডিটেকটিভ-ইরোটিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক ধরনের উপন্যাসের কথা তো বলাবাহুল্য, যদিও এই ছাঁচে এখন আর কোনো উপন্যাসের বিচার চলে না!) এ ছাড়া কথাসাহিত্যের সকল বর্গেই হ‌ুমায়ূন ফলিয়েছেন ‘অগণিত হৃদয়শস্য’। এর ভেতরে চিটাধানের গানও কম বেজে ওঠে না। তাহলে কীভাবে পড়ব হ‌ুমায়ূনকে?

 

সোজা কথায় তাঁকে পড়তে হবে তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখাগুলির ভিত্তিতে। দুর্বলতা দিয়ে অবশ্যই মানুষের একটি দিক চেনা যায়, কিন্তু সামর্থ্য দিয়েই আসলে বিচার করতে হয়। বলাবাহুল্য, এমন কোনো মানুষ নেই, যার কোনো দুর্বল-জায়গা নেই। শরীরে বা মনে কমবেশি কোনো না কোনো ক্ষেত্রে মানুষ একটু নাজুক থাকে। নিন্দুকদের কথায় পেডোফেলিয়ার অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। এ তো গেল মনোগত। লেখার ক্ষেত্রেও বহু লেখায় অসামান্য সূচনা করে কিছু দূর এগিয়েই দম রাখতে না পেরে এলিয়ে গেছে সেসব লেখা। পরেই সেটি হালকা রম্য হলে ভালো ছিল কিন্তু রীতিমতো ‘ফাতরা’ হয়ে গেছে! ঠাট্টামস্করা অসুখের মতো ঘিরে ফেলেছে সেসব লেখাকে। অথচ তা তো আর ‘দন কিহোতে’র মতো হয়নি।

পি. জি. উডহাউসের কথাও কি বলতে পারি? শোনা যায়, বুদ্ধদেব বসুর বেশ প্রিয় ছিলেন উডহাউস।

২.
মূলত গল্প ও উপন্যাসই হ‌ুমায়ূন আহমেদের মূল জগৎ। যদিও শিশুসাহিত্য, মিসির আলি, হিমু, শুভ্র, আত্মজৈবনিক লেখা আর ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে কত কী লিখেছেন! ছিলেন বৃক্ষপ্রেমী, দাবাখেলাপ্রিয় ও ম্যাজিকে মজতে পারা মানুষ। গাছ নিয়ে লিখেছেন আলাদা বই। ৫০টি ঔষধি গাছ নিয়ে ‘বৃক্ষকথা’ বইটি বোধ করি তাঁর পদার্থবিদ্যা নিয়ে লেখা বইটির মতোই সবচেয়ে কম বিক্রির তালিকায় পড়ে আছে।

 

হ‌ুমায়ূন আহমেদের সেরা সাহিত্যি সৃষ্টি তাঁর ছোটগল্প। বাজারে তাঁর ‘গল্পসমগ্র’ পাওয়া গেলেও, এর বাইরে রয়ে গেছে ‘সুখী মানুষ’ বা ‘সংসার’সহ বেশ কিছু ছোটগল্প। তাঁর ছোটগল্পের একটি সুসম্পাদিত সমগ্র, পারলে কয়েক খণ্ডে প্রকাশ করা বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য, বাংলা সাহিত্যের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় কাজ। কিন্তু আজো অব্দি সেটি হয়নি। সবচেয়ে মারাত্মক হলো: তাঁর যে যে বই বিপুলভাবে বিক্রি হয়, অসংখ্য মুদ্রণ হলেও, বইগুলিতে প্রুফে/বানান ভুল প্রথম মুদ্রণ থেকে সাম্প্রতিক মুদ্রণ পর্যন্ত একই থেকে গেছে। এটা হ‌ুমায়ূন আহমেদের যতটা দুর্ভাগ্য, তার চেয়ে বেশি আমাদের।

প্রকাশকরা এর পরোয়া করেন না, মনে হয় তাঁরা ধরেই নেন, হ‌ুমায়ূন-পাঠকদের বানান ঠিক বা ভুলের কোনো বালাই নেই। ক্ষতিটা যে বাংলা ভাষার ও সাহিত্যের এবং আরো গভীরতর ভবিষ্যতের জন্য- সে বিষয়েও তাদের কিছু যায় আসে না। অথচ মুনাফা ঠিকই হচ্ছে।

 

হ‌ুমায়ূনের ভালো বইগুলিও হেলাফেলা করে বিক্রি হচ্ছে। তবে, কোন বইগুলি হ‌ুমায়ূনের ভালো বই সেটি নিশ্চিতভাবে ঠিক করে দেওয়া কঠিন। যেমন বাজারে তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ উপন্যাস’ নামে যেটি আছে (এক বা একাধিকও হতে পারে, যেভাবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র নিয়ে, হিমু মিসির আলি নিয়ে একাধিক প্রকাশকের হরেক রকমের প্রকাশনা আছে) তাতে জড়ো করা হয়েছে: নন্দিত নরকে, অচিনপুর, অন্যদিন, সবাই গেছে বনে, আমার আছে জল, ফেরা, আগুনের পরশমণি, দূরে কোথাও, আকাশ জোড়া মেঘ, সাজঘর, চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক, জনম জনম, গৌরপুর জংশন, কৃষ্ণপক্ষ ও তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে।

‘হ‌ুমায়ূন আহমেদের স্বনির্বাচিত উপন্যাসে’ মিলবে: আমার আছে জল, নক্ষত্রের রাত, অন্ধকারের গান, তোমাকে, নীল অপরাজিতা, আকাশ জোড়া মেঘ, দিনের শেষে, দ্বৈরথ, আগুনের পরশমণি, একজন মায়াবতী, সাজঘর ও কৃষ্ণপক্ষ।

 

‘দশটি উপন্যাস’ নামের উপন্যাস সংকলনে আমরা পাবো: অচিনপুর, অন্যদিন, তোমাকে, দেবী, আগুনের পরশমণি, দূরে কোথাও, আকাশ জোড়া মেঘ, সাজঘর, জনম জনম ও কোথাও কেউ নেই। এ ছাড়া হ‌ুমায়ূন আহমেদের নির্বাচিত প্রেমের উপন্যাস ‘ভালোবেসে যদি সুখ নাহি’ বা প্রেমের উপন্যাস ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ নামের মতো উপন্যাস সংকলনে পাঠক কমন কিছু উপন্যাস পেয়ে যাবেন।

প্রশ্ন হলো এগুলিই কি তাঁর সবচেয়ে সেরা লেখা? আশ্চর্যজনক হলেও দেখি এর কোনোটিতেই ‘শঙ্খনীল কারাগার’ নেই। কোনোটিকে ‘নন্দিত নরকে’ থাকলেও আরেক জায়গায় এর ঠাঁই হয়নি। অথচ সাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন আহমেদকে প্রথমত ও প্রধানত যে দুটো উপন্যাস দিয়ে সত্যিকারভাবে চেনা যায় সে দুটিই হলো: নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার। এছাড়া ‘ফেরা’র মতো আকারে মাঝারি এবং একদম ছোট কিন্তু দারুণ তীব্র অনুভূতিসঞ্চারী ‘নির্বাসন’ বাদ দিয়ে তাঁকে ভাবা যায় না। যেমন ‘রূপা’, ‘শীত’, ‘অচিন বৃক্ষ’, ‘জলিল সাহেবের পিটিশান’, ‘একজন সুখী মানুষ’, ‘ভয়’, ‘চোখ’, ‘পাপ’, ‘জ্বিন কফিল’, ‘পিঁপড়া’, ‘একটি নীল বোতামে’র মতো ছোটগল্প বাদ দিয়ে তাঁকে ভাবা যায় না। বলতে গেলে অল্প কিছু ব্যতিরেকে তাঁর প্রতিটি ছোটগল্পই উল্লেখযোগ্য। এটা তাঁর উপন্যাসের বেলায় বলা যায় না যে, অল্প কিছু বাদে তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই উল্লেখযোগ্য। তাঁর আকারে একটু বড় ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহি’- এসব টিভিতে ধারাবাহিক হিসেবে প্রচারিত হয়ে পরে বই হয়েছে। বাস্তববাদী উপন্যাসের বহু লক্ষণ থাকার পরও তিনি তাঁর প্রথাগত রোমান্টিক ধাঁচ থেকে বেরুতে পারেননি।

অন্যদিকে, করুণরসে ভেজা তাঁর ছোটগল্পগুলির মূল আবেদন আবেগের কাছে। বলাবাহুল্য এর কোনোটিই দোষের নয়। কিন্তু উপন্যাস বলতে যে মহৎ বৃহৎ ঘননিবিড় জীবনবোধে মন্দ্র ও গ্রন্থিল গদ্যে যে লেখা, সেটি তাঁর ধাতে ছিল না। ছিল না বলেই ‘মধ্যাহ্ন’, ‘মাতাল হাওয়া’, ‘লীলাবতী’, ‘কে কথা কয়’, ‘কবি’, ‘অপেক্ষা’, ‘দূরে কোথাও’ অসাধারণ সম্ভাবনার পরও প্রকৃত উপন্যাস হতে পারেনি। কারণ উপন্যাস বলতে আমাদের সামনে এখন ‘গড় শ্রীখণ্ড’, ‘নয়নতারা’, ‘রাজনগর’, ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘কেয়াপাতার নৌকো’, ‘খোয়াবনামা’, ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘অলীক মানুষ’, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’, ‘তিস্তাপুরাণ’, ‘কুবেরের বিষয় আশয়’, ‘আলো নেই’, ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ তো আছেই। তার আগে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘সুহাসিনীর পমেটম’, ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’-এর মতো লেখাগুলি না রেখে তো উপায় নেই। বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ ও তিনবাড়ুজ্জের কথা নয় বাদই দিলাম। বর্তমানে শারদীয় রোদে তপ্ত পূজাসংখ্যায় বা শাওয়ালের বাঁকানো চাঁদে ঈদসংখ্যার ঝাঁপিতে সংখ্যায় কম হলেও মারাত্মক সব ছোট উপন্যাসের জুড়ি মেলে।

মোহাম্মদ আজমের ‘হ‌ুমায়ূন আহমেদ: পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য’ সেরা লেখার আলোকে হ‌ুমায়ূনকে পড়ার দুয়ার খুলতে চেয়েছেন। হ‌ুমায়ূনের বিপুল সৃষ্টি থেকে আজমের বাছাইয়ে সহমত বা আপত্তি দুয়ের সুযোগই যথেষ্ট, কিন্তু এই সত্যটি আজম ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, হ‌ুমায়ূন আহমেদ আমাদের সাহিত্য জগতের নায়ক। ‘হিরো’ ছাড়া জাতি টেকে না। এই হিরো সিনেমার হিরো যেমন, তেমনই চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতার বেলায়ও। খেলাধুলাও এই সৃষ্টিশীলতার বাইরে নয়। নায়ক না থাকলে, নায়ক বানিয়ে নিতে হয়। বাঙালি মুসলমানের নায়ক-সংকট প্রবল বলেই রাজনীতিতেও আমরা দুর্বল ও অধস্তন হয়ে আছি।

বাংলাদেশের সাহিত্যের জগতের উপন্যাসের ক্ষেত্রে ক্যারিশমা অর্জন করেছেন মূলত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং পরে শহীদুল জহির। শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, মাহমুদুল হক অতীব গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেও তাঁদের সেই ক্যারিশমা ততটা তৈরি হয়নি। পূর্ববর্তী আবুজাফর শামসুদ্দীন, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, রশীদ করীম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, রিজিয়া রহমানসহ আরো অনেকের প্রাণদিয়ে লেখা উপন্যাসগুলির বেশিরভাগই গদ্য, চরিত্র নির্মাণ, অন্তর্দর্শন ও সর্বোপরি আধুনিকতার বিবেচনায় টলটলায়মান দশায় কাঁপতে থাকে।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ সেই অর্থে উপন্যাস নিয়ে কোনো তত্ত্বের বা ছাঁচের ধার দিয়েও একাট্টাভাবে হাঁটেননি। নিজের খেয়াল খুশিতে তিনি কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন বটে, কিন্তু সেটিও তাঁর নিজস্ব সাহিত্যিক মেজাজের বাইরে গিয়ে নয়। নিজের লেখা গদ্যে তৈরি করেছিলেন স্টাইল, একান্ত হ‌ুমায়ূনীয়শৈলী তেমন লেখার উপায়-উপকরণের বেলায় নিজের ধাত ও ধারার বাইরে ঝুঁকি নেননি। ফলে নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া প্রকাশকের চাপ ও পাঠকের চাহিদা তো ছিলই। যদিও বলা হয়: কারো মুখ চেয়ে তিনি লেখেননি। কিন্তু তাঁর প্রবণতাটাই এমন যে, তা আপনাআপনি বাজারের মুখের দিকে নুয়ে যেত। ফলে যে-সম্ভাবনা নিয়ে আহমদ শরীফ হ‌ুমায়ূন আহমেদকে শুরুতে শনাক্ত করেছিলেন, সেটি পুরো সঠিক থাকলেও, হ‌ুমায়ূন শেষাবধি সেটি পূরণ করতে পারেননি। যদিও অনেক প্রগাঢ় জীবনানুভূতির মুখোমুখি তিনি আমাদের দাঁড়া করিয়ে দিয়েছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখাগুলিতে।

হ‌ুমায়ূনের যে-বিপুল রচনা, সেখানে তার শ্রেষ্ঠ বা সেরা লেখাগুলি জড়ো করলে, সেসব বাঙালি বহু লেখকের সারাজীবনে লেখার পরিমাণের চেয়ে বেশি। কিন্তু সাহিত্য তো পরিমাণ দিয়ে যাচাইবাছাই হয় না। গুণগত মানই সাহিত্যের মান; ঠিক মহিমান্বিত জীবন ও মহৎ মানুষের মতো। এ কারণে আমরা টের পাই, লোকসংখ্যা যেমন বেড়েছে, মানুষের সংখ্যা সে তুলনায় বাড়েনি। হ‌ুমায়ূন আহমেদের প্রথম দুটো উপন্যাসই যেন তাঁর নিজের নিয়তির হয়ে গেছে। তিনি সাহিত্যের জগতে নন্দিত হয়েছেন, কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টির নরকের আগুনে পুড়িয়ে যতটা সোনা ফলানোর সামর্থ্য তাঁর ছিল, তিনি সেটি ফলাতে পারেননি। নিজেরই তৈরি লেখার ধরনে-গড়নের শঙ্খনীল কারাগারে নিজেকে বন্দি করেছিলেন। তদুপরি, হুমায়ূন আহমেদকে পেতে হবে তাঁর শ্রেষ্ঠ লেখার দিক থেকেই। সেসব লেখাও পরিণমাণে কম নয়। ফলে তাঁর যা কিছু শ্রেষ্ঠ, সেসবই তাঁকে পড়ার, মূল্যায়ন করার ও বোঝার জন্য যথেষ্ট।

Source URL: https://newsside24.com/?p=1725